শিখে এলাম কুংফু ফ্যান

মানব জমিন থেকে নেওয়া খ্যাতনামা রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, যদি আফগান যাবো তবে কেন কাবুলিঅলা হবো না। চীনে বেড়াতে গিয়ে এটাই বার বার মনে হয়েছে। আর আয়োজকরা ইয়ুথ সামার ক্যাম্প সাজিয়েছেনও সেভাবেই। যতই দিন যাচ্ছিল ততই নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলাম। আর চীনের যেকোনো বিষয়কেই একটি দার্শনিক যুক্তি দিয়ে দেখার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। তা খাওয়া থেকে খেলা সবকিছুতেই। প্রতি রাতেই আমরা জানতাম কাল কি? একদিন খুদে বার্তায় জানতে পারি কাল আমাদের লাইব্রেরির সামনের মাঠে ‘কুংফু ফ্যান’ শেখানো হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম কিরে বাবা এটা আবার কি? কাল সকালে কি মাঠে দাঁড়িয়ে কুংফু শিখতে হবে? আদতেও তাই করতে হলো। তবে আমাদের দলে থাকা অভিজ্ঞ কামাল ভাই বললেন, এটা হচ্ছে ‘তাই চি’। চীনারা এর মাধ্যমেই শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখে। এটাই এখানকার মেডিটেশন। আমরা যেভাবে ইয়োগা বা যোগ ব্যায়াম করি ঠিক একইভাবে চীনারা ‘তাই চি’ বা কুংফু ফ্যানে অভ্যস্ত। সকালে মাঠে দাঁড়াতেই আমাদের হাতে নানা রঙের পাখা ধরিয়ে দেয়া হলো। লি ইউয়ান পে আর ইয়ানতুন ফাং এই দুই তরুণ তুর্কী আমাদের আজকের লাওশি। পর পর দু’দিন আমাদের কুংফু ফ্যান চর্চা চললো। পরে এমন অবস্থা হয়েছে রাতে হোটেলে ফিরেও আমি ফ্যান হাতে নিয়ে বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করেছি। সেই ফ্যান ঢাকা অব্দি পৌঁছেছে। শুধু কি ফ্যান। গো বা গোপাং (Gobang) বোর্ডও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। এটি আমাদের শিখিয়েছেন ওয়েন ম্যাং। গোপাং অনেকটা আমাদের এখানে ষোল ঘুঁটি খেলার মতোই। তবে দর্শনগত দিক থেকে তফাৎ আছে। গোপাং-এ সব সময় দুই পক্ষ সৈনিক মাঠে থাকে। সাদা ও কালো। এর একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে যেকোনো দলের পাঁচটি ঘুঁটি যদি একই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহলে কিস্তিমাত। আর চাইনিজরা তাদের দাবা খেলাও সাজিয়েছেন নিজেদের মতো করে। এটা তাদের রীতিনীতি মাথায় রেখেই তৈরি। উইচি (গো) গো নামটি এসেছে জাপানি শব্দ ইগো থেকে। এর চাইনিজ নাম উইচি। ইংরেজিতে এটাকে এক শব্দে বলা হচ্ছে ঊহপরহপষরহম মধসব। চাইনিজরা এই খেলাকে গোপাং-ও (এড়নধহম) বলে থাকে। এর বাংলা হচ্ছে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলা বা বৃত্তাবদ্ধ করা। এ খেলায় সাতের অধিক রীতি রয়েছে। এটি চাইনিজ মানুষ প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে খেলছে। বলা হয়ে থাকে এটি চীনের সবচেয়ে প্রাচীন বোর্ড গেম। যা এখনো চীনের পথে-প্রান্তরে, মহল্লায়-মহল্লায়, বাজার-হাটে, বাড়িতে-বাড়িতে চর্চা হয়। চীনের প্রাচীন পণ্ডিতদের মধ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকলার একটি ছিল উইচি বা গো। প্রথমদিকে খেলাটিকে সহজ মনে হলেও কখনো কখনো এটি দাবার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন মনে হয়। দাবার সঙ্গে তুলনা করলে এটি দাবার চেয়েও অনেক বড় বোর্ডে খেলা হয়। আর খেলার সময়ও থাকে দীর্ঘ। প্রতিটি চালের জন্য এখানে বিকল্পও রয়েছে। সাধারণত আমার খেলায় ঘুঁটি ব্যবহার করি। কিন্তু এ খেলায় ঘুঁটিকে বলা হয় স্টোন বা পাথর। খেলার এক পক্ষ নেয় সাদা পাথর অন্য পক্ষ নেয় কালো পাথর। বোর্ডে রয়েছে ১৯টি ঘর। ২০০৮ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ গো বা গোপাং খেলে। এদের অধিকাংশই পূর্ব এশিয়ার। ২০১৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল গো ফেডারেশনে প্রায় ৭৫টি দেশ সম্পৃক্ত হয়। বর্তমানে অনেক দেশেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ওশাংচি (দাবা) চীনে দাবা খেলার রীতি আমরা সাধারণ যেভাবে দাবা খেলাকে জানি তেমনটা নয়। এখানকার অন্যান্য সকল বিষয়ের মতো দাবা খেলারও রয়েছে নিজস্ব রীতি। চীনা ভাষায় দাবাকে বলা হয় ‘ওশাংচি’। ইংরেজিতে ওশাংচিকে বলা হয় ঊষবঢ়যধহঃ এধসব। হাজার হাজার বছর ধরে চীনে এ পদ্ধতিতে দাবা খেলার চলন। চীনে দাবার ঘুঁটিগুলোও ভিন্ন রকমের। সাধারণত হাতি, ঘোড়া, রাজা, সৈন্য আমরা চিনতে পারি ঘুঁটি দেখে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। পশ্চিমে যে দাবা আমরা দেখি তার চেয়েও চীনে ওশাংচি (দাবা) খেলে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ। চীনের দাবার ঘুঁটিগুলোকে যে নামে সকলেই চিনে থাকে তা হচ্ছে রাজা বা কিংকে চীনে বলা হয় ওচিয়াং, মন্ত্রী বা রানীকে বলা হয় ওশিও, ঘোড়া বা হর্সকে বলা হয় ওশিয়াং, ঘোড়া ছাড়াও রয়েছে ঘোড়ার গাড়ি যা চুহ নামে পরিচিত। আছে কামান যা চীনা ভাষায় পাও নামে পরিচিত। এছাড়া রয়েছে সৈন্য যা ওপিং নামে পরিচিত। প্রচলিত দাবার সঙ্গে চাইনিজ দাবার যে ধরনের পার্থক্য রয়েছে তা উল্লেখ করা হলো- চীনে দাবা খেলায় আমাদের মন্ত্রীর মতো ঘোড়া সমান শক্তি নিয়ে চলতে পারে। চীনে মন্ত্রী বা হাতি শুধু দুই ঘর যেতে পারে। তার বেশি চলাচলের বিধান নেই। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী সর্বত্র অবাধে চলতে পারে। চীনা দাবায় চুহ বা ঘোড়ার গাড়ি দেখতে অনেকটা নৌকার মতো। সৈন্যরা চলতে পারে এক ঘর করে। কামান সাধারণভাবে চলতে পারে। তাই চি (Tai Chi) তাই চি হচ্ছে তিনের সমন্বয়। মন, শরীর ও আধ্যাত্মিকতার। তাই চিকে বলা হয় চীনের মানুষের মন ও শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ব্যায়াম। তাই চিকে বলা হয় গভীর জ্ঞান চর্চার পদ্ধতিও। চীনে তাই জীবনভর তাই চিকে সঙ্গী করে সুস্থতার জন্য। নানা ধরনের তাই চি রয়েছে চীনে। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চেন, ইয়াং, উ, হাউ এবং সান। সবগুলোই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে করলেও সকল পদ্ধতির উদ্দেশ্য একটাই। তাই চি চর্চায় মূল লক্ষ্য থাকে মনকে রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজে লাগানো বা প্রস্তুত করা। শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাভাবিক চলাফেরাকে গতিময় বা ছন্দ এনে দেয় তাই চি। চীনের লোকেরা তাই চিকে মার্শাল আর্টও বলে থাকে। এক্ষেত্রে শুধু একজন আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তা চর্চা করে তা নয়- দুইজনই দু’জনকে মোকাবিলা করে এবং নিজেদের মধ্যে সমতা নিয়ে আসে। চীনাদের বিশ্বাস এই সহানুভূতি বা সমতা সমাজকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে। তাই চি এই শিক্ষা দিয়ে থাকে চীনের নাগরিকদের। চেন নামক গ্রাম থেকেই তাই চি’র উৎপত্তি। তাই চি পাঁচটি ফর্মে করা হয়ে থাকে। তাওলু (Taolu), নেইকং এবং চিকং (neigong &‌ qigong), তুশাও (tuishou) এবং সানশাও (Sanshou)। তাওলু পদ্ধতিতে নিজের হাতকেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হয় এবং নিজকে রক্ষার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। নেইকং এবং চিকং-এ শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে ধ্যান চর্চা করতে হয়। তুশাওয়ে ধারাবাহিকভাবে কুচকাওয়াজ করতে হয়। আর সবশেষ সানশাও হচ্ছে ব্যক্তিগত। সাধারণত চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জোড়ায় জোড়ায় বা পার্টনার পদ্ধতিতে তুশাও পদ্ধতি শেখানো হয়। এতে করে দলবদ্ধভাবে কুচকাওয়াজের পাশাপাশি নিজেদের অংশীদারি ভিত্তিতে মোকাবিলা ও পারস্পরিক সহমর্মিতার চর্চা হয়।

0 Comment "শিখে এলাম কুংফু ফ্যান"

Post a Comment