বদরের যুদ্ধ
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ
জাস্টিস আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সূরা আলে ইমরানে ঘোষণা করেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালা বদর (যুদ্ধে)-এর ক্ষেত্রে এমন অবস্থায় তোমাদের সাহায্য করেছিলেন, যখন তোমরা সম্পূর্ণ সহায়-সম্বলহীন ছিলে। সুতরাং তোমরা অন্তরে (কেবল) আল্লাহর ভয়কেই জায়গা দিও, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত-১২৩)
এই আয়াতে হক আর বাতিলের ওই বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, ঐতিহাসিক যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন অসহায় দুর্বল অস্ত্রহীন সাহাবি মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বিশ্ববুকে শেরেকি-কুফরি এবং শয়তানি শক্তির কোমর ভেঙে তাদের এক মহাভীতিকর অবস্থায় নিক্ষেপ করেছিলেন। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান বদর প্রান্তরে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই বাতিল শক্তির হৃত্কম্পন শুরু হয়ে যায়। পবিত্র মক্কা নগরীতে ১৩টি বছর কাফের-মুশরিকরা অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিমরোলার অব্যাহত রেখেছিল মুসলমানদের ওপর। কাফেরদের এহেন অত্যাচার-নির্যাতন সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। কাফের শত্রুদের অত্যাচার-নির্যাতন যতই বৃদ্ধি পেত, আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতিবারই ধৈর্য ধারণের সবক দেয়া হতো। প্রতিরোধ বা মোকাবিলা করার অনুমতি তাদের ছিল না।
ধৈর্য ধারণ এবং সহিষ্ণুতার দীর্ঘ তের বছরের পরীক্ষা শেষে মদিনা মুনাওয়ারায় মুসলমানদের জিহাদের অনুমতি মিলে। প্রথমদিকে মক্কার কাফেরদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সর্বপ্রথম বড় মাপের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল বদর প্রান্তর। এই যুদ্ধে মুসলমানরা মূলত নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের কোনো পরিকল্পনা নিয়ে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হননি। বরং রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুব সংক্ষেপ একটি নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১৩ জনের একটি দল মক্কার কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী কাফেলার ওপর হামলা করার জন্য বেরিয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য যেহেতু ব্যবসায়ী কাফেলার ওপর আক্রমণ ও তাদের প্রতিরোধ ছিল, এজন্য মুসলমানদের বেশি সৈন্যসামন্তের প্রয়োজন ছিল না। অস্ত্রশস্ত্র এবং যুদ্ধারোহণেরও তেমন কোনো এন্তেজাম ছিল না।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল অসহায় দুর্বল, অস্ত্রহীনদের মুষ্টিমেয় এই ক’জন লোক দিয়েই কাফের-মুশরিকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া। তাই তিনি মুসলমানদের সে পথেই এগিয়ে নিলেন। মুসলমানরা হামলা করছে—এ সংবাদ জানার পর আবু সুফিয়ান ব্যবসায়ী কাফেলার গতিপথ ঘুরিয়ে ভিন্নপথে মক্কা পাড়ি জমানোর কৌশল অবলম্বন করল। সেই সঙ্গে মক্কায় তাদের নেতা আবু জাহেলের কাছে দ্রুত এই সংবাদ পাঠিয়ে দিল যে, কালবিলম্ব না করে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ কর। এখন আর মুসলমানদের বিপক্ষ শক্তি ব্যবসায়ী কাফেলা নয়; বরং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত তত্কালীন আরবের সাহসী বীর যোদ্ধাদের এক হাজারের এক বিশাল বাহিনী। পটপরিবর্তনের এই প্রেক্ষাপটে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন—বিশাল এই তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া না মদিনায় ফিরে যাওয়া। সাহাবায়ে কেরামের বড় সংখ্যক দলটিই নিজেদের অসহায়ত্ব, দুর্বলতা, সংখ্যাগৌণতা সত্ত্বেও অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গেই কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অভিমত দিলেন।
আর এভাবেই বদর প্রান্তরে মুসলমানদের স্বল্পসংখ্যক এই দলটিকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত আরবের যোদ্ধদের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আবু জাহেলের নেতৃত্বাধীন এই বিশাল বাহিনী ছিল লৌহবর্ম পরিহিত। আর যেহেতু মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি ছাড়া বেরিয়েছিলেন, তাই তারা ছিলেন একেবারেই বলতে গেলে খালি হাতে।
আরবদের তত্কালীন সমরনীতির আলোকে ব্যাপকভাবে যুদ্ধ শুরুর আগে প্রথমে এককভাবে তিন জনের সঙ্গে মোকাবিলা হয়। একক যুদ্ধে হজরত হামযা (রাযি.) কাফের নেতা শাইবাহকে এবং হজরত আলী (রাযি.) ওয়ালিদকে হত্যা করতে সক্ষম হন। একক তৃতীয় যুদ্ধে হজরত ওবায়দা ইবনুল হারিস (রাযি.) তার প্রতিপক্ষ উতবা ইবনে রাবিয়্যাহকে চূড়ান্ত আক্রমণ করেন। কিন্তু এতে তিনি নিজেও আহত হন। তাকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে রাখা হলো। কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি শাহাদতের মর্তবা অর্জন করে আল্লাহর দরবারে লাব্বাইক বললেন।
এর পরপরই উভয় পক্ষের ভেতর শুরু হয়ে যায় তীব্র লড়াই। কাফের তাগুতি শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ছিল মত্ত-মাতোয়ারা, আসবাবপত্রের কোনো ঘাটতি ছিল না তাদের, যুদ্ধ বিজয়ে যা যা প্রয়োজন তার কোনোটিরই অভাব ছিল না তাদের। অপরদিকে গোনাবান্দা ক’জন মুসলমান, তাদের কাছে না ছিল কোনো আসবাবপত্র, ছিল না উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু তারা ছিলেন ঈমানী বলে বলীয়ান, আল্লাহর ওপর আস্থা-বিশ্বাস ও ভরসা ছিল তাদের পরিপূর্ণ। হক এবং সত্য প্রতিষ্ঠার ঝাণ্ডাবাহী ছিলেন তারা। এই দুর্বল বাহিনী সেদিন যে দুর্দান্ত সাহসিকতা নিয়ে তাগুতি শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। আবু জাহেলের নেতৃত্বাধীন আরব যুদ্ধবাজদের বিশাল শক্তিশালী বাহিনী, যারা নিমিষেই মুসলমানদের গিলে ফেলার নেশা নিয়ে এসেছিল; যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদেরই আর কোনো আশ্রয়স্থল ছিল না।
রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সশরীরেই শুধু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি; বরং হজরত আলীর (রাযি.) বর্ণনামতে, যুদ্ধের ময়দানে আমরা যখন কাফেরদের আঘাতে টিকে থাকতে হিমশিম খেতাম, তখন আমরা মহানবীর আশপাশে এসে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতাম। কেননা রাসুলের সম্পর্ক ছিল বিশ্বস্রষ্টা মহাক্ষমতাশীল আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে। সাহাবায়ে কেরাম বদর প্রান্তরের একপাশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য একটি ছোট্ট ছাপড়া বানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বার বার ওই ছাপড়ার ভেতর যাচ্ছিলেন। আর আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে দোয়া করছিলেন, কান্নাকাটি-আহাজারি করছিলেন। তীব্র যুদ্ধ চলছে। হজরত আবু বকর (রা.) সেই ছাপড়ায় ঢুকে দেখতে পেলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আর আল্লাহর দরবারে বলছেন : ‘হে আল্লাহ! গোনাবান্দা মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই দুনিয়ার বুকে ইবাদতের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আপনার সেই সাহায্য অবতরণ করুন, যা দেয়ার অঙ্গীকার আপনি আমার সঙ্গে করেছেন।’
আল্লাহর অঙ্গীকার ছিল সত্য, তিনি মুসলমানদের সাহায্যে ফেরেশতা দল পাঠালেন। আর দেখতে দেখতে এই দুর্বল বাহিনীর হাতে কাফেরদের নামিদামি, বীর লড়াকু ৭০ জন যুদ্ধবাজ নেতা নিহত হয়। স্বয়ং আরবদের নেতা আবু জাহেল দুই মুসলিম বালকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। আরও ৭০ জন কাফের নেতা মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। এভাবে মক্কার কাফেরদের অহঙ্কার চিরতরে মাটির সঙ্গে মিশে ধূলিসাত্ হয়ে যায়।
সূরা আল ইমরানের আলোচিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বদরের এই বিশাল বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আরও বলেন, আল্লাহ তায়ালা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে তোমাদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন। সুতরাং একইভাবে ওইসব ক্ষেত্রেও তোমাদের সাহায্য করতে সক্ষম, যখন তোমরা সততা ও ইখলাস সহকারে তাঁর দ্বীনের পারচাম বুলন্দ করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। যেমন আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—‘তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।’ অর্থাত্ আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের সঠিক পদ্ধতি হলো, তোমরা তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর। নিজের সারাটা জীবন তাঁর মর্জির অনুকরণে বানিয়ে নাও। হ
[অনুবাদ : মুহম্মদ তৈয়্যেব হোসাইন]
0 Comment "বদরের যুদ্ধ"
Post a Comment